ঢাকা | বঙ্গাব্দ

বিএনপির প্রার্থী নিয়ে তৃণমূলে বিভক্তি

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Nov 17, 2025 ইং
বিএনপির প্রার্থী নিয়ে তৃণমূলে বিভক্তি ছবির ক্যাপশন:
ad728
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না হলেও সারাদেশে বিরাজ করছে ভোটের আমেজ। ইতোমধ্যে পোস্টারে ছেয়ে গেছে রাস্তাঘাট, দেয়ালসহ বিভিন্ন স্থাপনা। গণসংযোগ, মিছিল, সভাসহ নির্বাচনি কর্মসূচিতে সরগরম থাকছে পাড়ামহল্লা। চায়ের দোকানে নিয়মিত ঝড় উঠছে বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনার। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল একক প্রার্থী দেওয়ায় নিরবচ্ছিন্ন প্রচারে ব্যস্ত নেতাকর্মীরা। তবে বিএনপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর বিভক্ত হয়ে পড়েছেন দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

পছন্দের নেতারা ধানের শীষের মনোনয়ন না পাওয়ায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন জাতীয়তাবাদীরা। প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে মিছিল, সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের একাংশ। কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমনকি ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসও আলাদাভাবে পালন করেছেন তারা। আবার এসব ছাপিয়ে যারা মনোনয়ন পেয়েছেন তারা নির্বাচনি এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন, চাইছেন ভোটারদের সমর্থন ও দোয়া।

রংপুর জেলার ছয়টি আসন ঘুরে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ধরে একক প্রার্থী নিয়ে প্রচারে দিন-রাত এক করে ফেলছেন জামায়াত নেতাকর্মীরা। সবার আগে দাঁড়িপাল্লার নমিনি ঘোষণা করায় গণসংযোগও শুরু করেছেন অনেক আগেই। ইতোমধ্যে ভোটের মাঠে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে সক্ষম হয়েছেন বলে দলটির নেতাকর্মীরা দাবি করেছেন।

রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া ও সিটি করপোরেশনের ৯ ওয়ার্ড) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন মোকাররম হোসেন সুজন ও জামায়াতে ইসলামীর অধ্যাপক রায়হান সিরাজী। রংপুর-২ (বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ) আসনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এটিএম আজহারুল ইসলাম ও বিএনপির মোহাম্মদ আলী সরকার দলের টিকিট পেয়েছেন। রংপুর-৩ (সদর ও সিটি করপোরেশন) আসনে জামায়াতের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল ও বিএনপির শামসুজ্জামান সামুকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

হাসিনার সব অপরাধেরই বিচার হওয়া উচিতহাসিনার সব অপরাধেরই বিচার হওয়া উচিত
রংপুর-৪ (কাউনিয়া ও পীরগাছা) আসনে বিএনপির ইমদাদুল হক ভাষা ও জামায়াতের অধ্যাপক এটিএম আজম খানকে টিকিট দেওয়া হয়েছে। রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনে জামায়াতের অধ্যাপক গোলাম রব্বানী ও বিএনপির মোহাম্মদ গোলাম রব্বানীকে দলীয় নমিনি করা হয়েছে। এছাড়া রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনে বিএনপির সাইফুল ইসলাম ও জামায়াতের মাওলানা নুরুল আমিন মনোনয়ন পেয়েছেন। এর বাইরে শুধু রংপুর-৪ আসনে প্রচার চালাচ্ছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন।

জেলা বিএনপির সদস্য মনিরুল ইসলাম, রফিকুল হক, সাদিকুল ইসলাম ও মো. নয়ন বলেন, রংপুরের ৬টি আসনে দলীয় নেতাকর্মীরা তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ধানের শীষে ভোট চেয়েছিলেন। বিশেষ করে রংপুর-১, ২ ও ৩ আসনে যাদের ধানের শীষ দেওয়া হয়েছে তারা ছিল আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ও চাঁদাবাজির অভিযোগে অভিযুক্ত। দুর্দিনে তারা নেতাকর্মীদের পাশে না থেকে নিজেদের সুবিধা হাসিল করার জন্য নেতাকর্মীদের দূরে ঠেলে দিয়ে ফ্যাসিবাদীদের সঙ্গে আঁতাত করে গা বাঁচিয়ে চলেছেন।

তারা আরো বলেন, এসব বিতর্কিত নেতাই জুলাই বিপ্লবে নতুন করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজির মাধ্যমে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। এ কারণে দলীয় নেতাকর্মীরা তাদের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে দূরে চলে গেছেন। এরপর দল মনোনয়ন দেওয়ায় আশাহত ও বিক্ষুব্ধ হয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তাই অনেকে বিভক্ত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিও পৃথকভাবে পালন করা হচ্ছে। এতে বিভিন্ন স্থানে বিরোধ দেখা দিচ্ছে, সংঘর্ষও হচ্ছে।

বিএনপির এই নেতারা বলেন, ছয় প্রার্থীর মধ্যে দু-একজন ছাড়া সবাই চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব এবং আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের পুনর্বাসন করেছেন। দলীয় নেতাকর্মীরা তাদের প্রতি অনাস্থা জানানোয় তারা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ নিষিদ্ধ সংগঠনের ক্যাডার, সমাজের বিতর্কিত ও অপরাধীদের দিয়ে নির্বাচনি কাজ করাচ্ছেন। এ কারণে সাধারণ মানুষ এমনকি প্রশাসনও ওইসব অপরাধী ও আওয়ামী ক্যাডারের বিরু্দ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে নির্বাচনে ভরাডুবি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক শহিদুল হক মানিক বলেন, রংপুর-২ আসনে বিএনপি মোহাম্মদ আলী সরকারকে মনোনয়ন দেওয়ায় বিভক্ত হয়ে পড়েছেন নেতাকর্মীরা। কারণ, মোহাম্মদ আলী বিএনপিতে অনুপ্রবেশকারী। তিনি দখলবাজি ও সন্ত্রাসী কাজে জড়িত। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগের দোসর জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। তিনি অর্থের বিনিময়ে কবরস্থান ও এতিমখানার জমিও দখল করেছেন। দল তাকে মনোনয়ন দিলেও তার আচরণের কারণে উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ তৃণমূলের কেউ তার সঙ্গে নেই।

জামায়াত নেতা গোলজার হোসেন, সিরাজুল ইসলামসহ একাধিক নেতা বলেন, দাঁড়িপাল্লার প্রার্থীরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, টেন্ডারবাজি বা তদবির বাণিজ্যসহ কোনো বেআইনি কাজের অভিযোগ নেই। দলের ভেতরেও কোনো কোন্দল নেই। তাই তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জামায়াত প্রার্থীদের বিজয়ী করতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।

রংপুর-১ আসনে জামায়াতের প্রার্থী অধ্যাপক রায়হান সিরাজি বলেন, ‘আমরা যেভাবে জনগণের সাড়া পাচ্ছি আশা করি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে দাঁড়িপাল্লা বিজয়ী হবে— ইনশাল্লাহ।’ একই আসনে বিএনপির প্রার্থী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘এখানে নেতাকর্মীদের মধ্যে তেমন কোনো বিভেদ নেই। আশা করি সবাই মিলে ধানের শীষকে বিজয়ী করবে।’

রংপুর-২ আসনে জামায়াতের প্রার্থী এটিএম আজহার বলেন, ‘প্রায় দেড় দশক আমাকে অন্যায়ভাবে বন্দি করে রেখেছিল জালিম সরকার। এই দীর্ঘ সময় এলাকার মানুষ আমাকে না দেখেও আমার জন্য দোয়া করেছেন। ভোটের রাজনীতিতেও অনুরূপ সাড়া দিচ্ছে জনগণ। সভা-সমাবেশে হাজির হয়ে দিচ্ছে অকুণ্ঠ সমর্থন। এখানেও দাঁড়িপাল্লার বিজয় হবে— ইনশাআল্লাহ।’

একই আসনের বিএনপির প্রার্থী আলী সরকার বলেন, ‘এখন নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে না থাকলেও হাই কমান্ডের নির্দেশে পরে তারা আমার সঙ্গে থাকতে বাধ্য হবে।’

রংপুর-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী দলটির মহানগর শাখার আহ্বায়ক শামসুজ্জামান সামু বলেন, ‘এখানে কিছু দলীয় ছেলেপেলে বিভ্রান্তি তৈরি করলেও সামনে সবাই একত্রিত হয়ে মাঠে কাজ করবে। দলের নির্দেশে সবাই একত্রিত হলে জয়লাভ করা সম্ভব।’

একই আসনে জামায়াতের প্রার্থী দলটির কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীরা অনেক নির্যাতিত ছিল। তারা এবার একত্রিত হয়ে মাঠে কাজ করছেন। আশা করি, বিপুল ভোটে জয়লাভ করব। কারণ, আমাদের কোনো দলীয় কোন্দল নেই।’

রংপুর-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী এমদাদুল হক ভরসা বলেন, ‘বিএনপি বড় দল বিভিন্ন প্রোগ্রামে দলকে খুশি করতে নানা ধরনের কথা বলতেও হয়। সব কথা ধরলে চলবে না। আগেও আমি এখানে বিএনপির প্রার্থী ছিলাম, এবার আশা করি, জনগণের বিপুল ভোটে বিজয়ী হব।’

বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলার হিড়িকবিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলার হিড়িক
একই আসনে জামায়াত প্রার্থী এটিএম আজম খান বলেন, ‘মানুষ এখন ইসলামের পথে। ন্যায়-অন্যায় সবাই ভালো করে বোঝেন। কারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে চায় সেটিও সবাই দেখছেন, শুনছেন। তাই এলাকার মানুষ দাঁড়িপাল্লা মার্কায় ভোট দিয়ে জামায়াত প্রার্থীকে বিজয়ী করবে— ইনশাল্লাহ।’

এ আসনে তৎপর এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে জনগণ এনসিপিকেই বেছে নেবে। আশা করি, আমরা বিপুল ভোটে জনগণের ভালোবাসা নিয়ে বিজয়ী হব।’

রংপুর-৫ আসনের জামায়াতের প্রার্থী দলটির কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য ও জেলা শাখার আমির অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘আমরা নির্যাতিত আমরা মজলুম এটা সবাই জানে, এ কারণে এ আসনে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বিপুল ভোটে বিজয়ী হবে— ইনশাল্লাহ।’

একই আসনে বিএনপির নমিনি গোলাম রব্বানী বলেন, ‘এখানে দলীয় নেতাকর্মীরা, একত্রিত হয়ে কাজ করছি। আশা করি, ধানের শীষের বিজয় হবে।’

রংপুর-৬ আসনের বিএনপির প্রার্থী দলটির জেলা শাখার সদস্য সচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকাশ্যে এখানে দলীয় কোনো কোন্দল নেই। অনেক আগে থেকেই আমরা মাঠে কাজ করছি। আশা করি, মানুষ জিয়াউর রহমানের আদর্শকে সামনে রেখে বিপুল ভোটে ধানের শীষকে বিজয়ী করবে।’

একই আসনে জামায়াত প্রার্থী মাওলানা নুরুল আমিন বলেন, ‘আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা পোস্টারে আমার ছবির মাথা ও মুখে গোবর মেখে দিয়ে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন। এতে জনগণ আমার প্রতি আরো বেশি আকৃষ্ট হয়েছে। আমাদের ডাকে আগের চেয়ে বেশি সাড়া দিচ্ছে। আশা করি, নির্বাচনে বিপুল ভোটে দাঁড়িপাল্লার জয় হবে।’

বিএনপি মনোনীত প্রার্থী পছন্দ না হওয়ায় ইতোমধ্যে রংপুর-২ আসনে দলটির আরো এক নেতা নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। এখনো মাঠে তৎপর আছেন আজিজুল হক। এছাড়া রংপুর-৩ আসনেও স্বতন্ত্রভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন দলটির আরেক নেতা মাহফুজুর নবী ডন।

তারা বলেন, দল ইচ্ছা করলে এখনো মনোনয়ন পরিবর্তন করতে পারে । যেহেতু আমরা অনেক আগে থেকে মাঠে কাজ করছি এবং তৃণমূলের নেতাকর্মীরা আমাদের সঙ্গে আছেন, সেহেতু ধানের শীষের কাণ্ডারী নিয়ে পুনর্বিবেচনা জরুরি।

ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সরোয়ার জাহান বলেন, রংপুর-২ তথা বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম প্রার্থী হয়েছেন। তিনি পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। তার নামে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতিতো দূরের কথা কারো ছোট-খাটো কোনো অভিযোগও নেই। তিনি যেহেতু মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছেন সে ক্ষেত্রে এবং তার ব্যবহারে এবার দলমতনির্বিশেষে এই এলাকার মানুষ তার পক্ষেই থাকবে বলে বোঝা যাচ্ছে।

সিনিয়র আইনজীবী বায়েজীদ ওসমানীর একই মত। তিনি বলেন, সুশৃঙ্খল ও সৎ নেতৃত্বের ফলে জামায়াত প্রার্থীরা অন্যান্য আসনেও এগিয়ে থাকবেন। তাদের পক্ষে এবার জোয়ার তৈরি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

নিউজটি পোস্ট করেছেন : Hatiyar Kotha

কমেন্ট বক্স